আলোর অপবর্তন

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - পদার্থবিদ্যা - পদার্থবিজ্ঞান – ২য় পত্র | | NCTB BOOK
1

আমরা জানি, আলো সরল পথে চলে। আলোক রশ্মির পথে কোনো অস্বচ্ছ বস্তু স্থাপন করলে ঐ বস্তুর ছায়া সৃষ্টি হয়। এটি আলোর সরলরেখ গতির একটি প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আলোক রশ্মির পথে কোনো তীক্ষ্ণ ধার বিশিষ্ট কোনো অস্বচ্ছ বস্তু স্থাপন করলে বস্তুর যে ছায়া সৃষ্টি হয় তা ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, আলোর সরলরেখ গতির নিয়মানুযায়ী যে রূপ ছায়া হওয়া উচিত, ঠিক সে রূপ ছায়া হচ্ছে না। দেখা যায় যে, ছায়ার সীমারেখার মধ্যেও কিছুটা আলোক তীব্রতা থাকে যা দ্রুত হ্রাস পেয়ে শূন্য হয়। অর্থাৎ কিছু আলো এমন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে যে অঞ্চলে আলো শুধু সরলরেখায় গমন করলে অন্ধকার থাকার কথা। এ থেকে বোঝা যায় যে, কোনো প্রতিবন্ধকের ধার ঘেঁষে আলো সরল পথে না চলে কিছুটা বেঁকে যায় এবং আলো জ্যামিতিক ছায়া অঞ্চলের সামান্য ভেতর পর্যন্ত প্রবেশ করে । আলোর অপবর্তনের জন্য এরূপ ঘটে।

কোনো প্রতিবন্ধকের ধার ঘেঁষে বা সরু চিরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় জ্যামিতিক ছায়া অঞ্চলের মধ্যে আলোর বেঁকে যাওয়ার ঘটনাকে আলোর অপবর্তন বলা হয়।

তীক্ষ্ণধার প্রতিবন্ধক, কোনো ছিদ্র বা চিরের আকার যদি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সাথে তুলনীয় বা প্রায় সমান হয় তাহলে অপবর্তনের ঘটনা লক্ষণীয় হয়। সকল প্রকার তরঙ্গ অপবর্তন প্রদর্শন করে।

নিজে কর : দিনের বেলা ঘরের জানালার বা রাতের বেলা আলোক উৎসের বিপরীত পাশের দেয়ালের সামনে হাতের আঙ্গুল প্রসারিত করে ধরো।

ধরা যাক, S একটি আলোক উৎস এবং তার সামনে একটি অস্বচ্ছ প্রতিবন্ধক AB । প্রতিবন্ধকের পেছনে PQ একটি

পর্দা (চিত্র ৭.১১)। আলো সরলরেখায় গমন করে বলে পর্দার ওপর AB প্রতিবন্ধকের একটি ছায়া MN গঠিত হবে। কারণ, প্রতিবন্ধকের জন্য উৎস থেকে কোনো আলো MN অঞ্চলে এসে পৌঁছাতে পারে না। MN অংশ সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকবে। M বিন্দুর ওপরে এবং N বিন্দুর নিচে পর্দার সমস্ত অংশ সমভাবে আলোকিত হবে কারণ ঐ অঞ্চলে উৎস থেকে আলো পৌঁছাতে কোনো বাধা পায় না। কিন্তু খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, M বিন্দু এবং N বিন্দু থেকে হঠাৎ অন্ধকার শুরু হয় না। অর্থাৎ ছায়ার দুই প্রান্ত খুব তীক্ষ্ণ (Sharp) নয়। M বিন্দুর নিচে এবং N বিন্দুর ওপরেও কিছু অংশে অল্প অল্প আলোর অনুপ্রবেশ ঘটে। অর্থাৎ আলোর অপবর্তন হয়।

চিত্র :৭.১১

ব্যাখ্যা:

 ধরা যাক, S উৎস থেকে কোনো এক সময় তরঙ্গমুখ AB প্রতিবন্ধকে উপস্থিত হলো। এখন হাইগেনসের নীতি অনুযায়ী অগ্রসরমান প্রতিটি তরঙ্গমুখের উপর অবস্থিত কণাগুলো গৌণ তরঙ্গসমূহের উৎসরূপে ক্রিয়া করে। হাইগেনসের নীতি অনুসরণ করে অণুতরঙ্গ অঙ্কন করলে দেখা যায় A ও B এর নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে কিছু কিছু গৌণতরঙ্গ MN ছায়া অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করে M বিন্দুর নিচে এবং N বিন্দুর ওপরে কিছু অংশকে আলোকিত করে।

অপবর্তনের শ্রেণিবিভাগ :

অপবর্তন দু শ্রেণির হয়ে থাকে; যথা-

(১) ফেন্সে শ্রেণির অপবর্তন (Fresnel diffraction)

(২) ফ্রনহফার শ্রেণির অপবর্তন (Fraunhoffer diffraction)

ফ্রেনেল শ্রেণির অপবর্তন : যে সকল অপবর্তনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক বা চির থেকে আলোকের উৎস বা পর্দা অথবা উভয়েই সসীম (finite) দূরত্বে অবস্থান করে সেই সকল অপবর্তনকে ফ্রেনেল শ্রেণির অপবর্তন বলে। এ ক্ষেত্রে আপতিত তরঙ্গমুখ গোলীয় বা সিলিন্ডার আকৃতির হয়ে থাকে ।

সুই, সরু তার বা সরু চিরের ওপর গোলীয় তরঙ্গমুখের আপতনে এ শ্রেণির অপবর্তন পাওয়া যায়।

ফ্রনহফার শ্রেণির অপবর্তন : যে সকল অপবর্তনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক বা চির থেকে আলোকের উৎস ও পর্দা উত্তরেই অসীম (infinite) দূরত্বে অবস্থান করে সেই সকল অপবর্তনকে ব্রুনহঙ্কার শ্রেণির অপবর্তন বলে। এ ক্ষেত্রে আপতিত তরঙ্গমুখ সমতল হয়ে থাকে।

কোনো উত্তল লেন্সের ফোকাসতলে একটি আলোক উৎস স্থাপন করলে লেন্সে প্রতিসরণের পর সমান্তরাল আলোক রশ্মিগুচ্ছ উৎপন্ন হয় সেগুলোকে কোনো প্রতিবন্ধক বা চিরের ওপর আপতিত করে ফ্রনহফার শ্রেণির অপবর্তন পাওয়া যায়।

একক বা দ্বি-চির, অপবর্তন গ্রেটিং প্রভৃতির সাহায্যে ফ্রনহফার শ্রেণির অপবর্তন পাওয়া যায় ।

একক চিরের দরুন অপবর্তন

Diffraction at a Single Slit

একটি সরু চির AB বিবেচনা করা যাক। এই চিরের প্রস্থ a চিরটি বই-এর তলের সাথে অভিলম্বভাবে অবস্থিত। এই চিরের সামনে একটি উত্তল লেন্স L1, স্থাপন করা আছে। এই লেন্সের প্রধান ফোকাসে স্থাপিত একটি সরু ছিদ্র S থেকে । তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একবর্ণী আলো লেন্সে প্রতিসরিত হয়ে সমান্তরাল গুচ্ছে পরিণত হয় (চিত্র ৭.১২)। এই সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছ সমতল তরঙ্গমুখের আকারে AB চিরের ওপর পড়ে। AB থেকে নির্গত আলোক রশ্মিগুচ্ছকে অন্য একটি উত্তল লেন্স L2 এর সাহায্যে তার ফোকাস তলে স্থাপিত MN পর্দার ওপর কেন্দ্রীভূত করা হয় ।

AB চিরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় আলোক রশ্মি A বিন্দুর ওপরে এবং B বিন্দুর নিচের দিকেও ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই O বিন্দুতে চিরের একটি সুতীক্ষ্ণ বিম্ব না হয়ে এর উভয় পাশে পর্যায়ক্রমে উজ্জ্বল ও কালো বর্ণের অপবর্তন ঝালর গঠিত হয়। AB চিরে অবস্থিত সমতল তরঙ্গমুখের প্রতিটি কণা সমদশা সম্পন্ন। ফলে ঐ সকল কণা থেকে গৌণ তরঙ্গসমূহ চিরের অক্ষ CO এর সমান্তরালে এসে L2, উত্তল লেন্স দ্বারা প্রতিসরিত হয়ে O বিন্দুতে একত্রিত হয়। এভাবে এরা O বিন্দুতে সমদশায় পৌঁছে গঠনমূলক ব্যতিচার গঠন করে এবং ঐ বিন্দুর প্রাবল্য তথা উজ্জ্বলতা সর্বোচ্চ বা চরম হয় । O বিন্দুকে মুখ্য চরম বিন্দু (Principal maximum) বলে ।

চিত্র :৭.১২

এখন ধরা যাক, কিছু গৌণ তরঙ্গ CO এর সাথে θ কোণে অপবর্তিত হয়ে CO অভিমুখের সমান্তরালে গিয়ে L2, লেন্সে আপতিত হয়। এখন লেন্স দ্বারা প্রতিসরিত হয়ে এগুলো O1 বিন্দুতে একত্রিত হয়। এক্ষেত্রে তরঙ্গগুলো সমান পথ অতিক্রম করে না বলে O1 বিন্দুতে ঐ সকল তরঙ্গের দশা এক হবে না। O1, বিন্দুর প্রাবল্য সর্বোচ্চ বা চরম (maximum ) হবে নাকি সর্বনিম্ন বা অবম (minimum) হবে অর্থাৎ বিন্দুটি চরম বিন্দু হবে না অবম বিন্দু হবে তা নির্ভর করবে গৌণ তরঙ্গগুলোর পথ পার্থক্যের ওপর । ৭.১২ চিত্র থেকে দেখা যায় যে, AB চিরের দুই প্রান্তবিন্দু A ও B থেকে নির্গত দুটি গৌণ তরঙ্গের পথ পার্থক্য

হচ্ছে AD = AB sin θ = a sine  θ

গাণিতিক হিসাবের সাহায্যে O1 বিন্দুটির অবম বা চরম হওয়ার নিম্নোক্ত শর্ত পাওয়া যায় ।

অবমের শর্ত : O বিন্দুর উভয় পাশে n তম অবম বিন্দুর জন্য অপবর্তন কোণ, θn , হলে

a sin  θn =nλ

চরমের শর্ত : O বিন্দুর উভয় পাশে n তম চরম বিন্দুর জন্য অপবর্তন কোণ θn, হলে

a sin θn= (2n +1) λ2

অপবর্তন গ্রেটিং বা ঝাঝরি

আলোর উৎসকে বিশ্লেষণের একটি অতি প্রয়োজনীয় কৌশল (device) হলো অপবর্তন গ্রেটিং। অনেকগুলো সমান ফাঁকবিশিষ্ট সমান্তরাল চির দিয়ে অপবর্তন যেটিং গঠিত।

সংজ্ঞা : পাশাপাশি স্থাপিত অনেকগুলো সমগ্রন্থের সুক্ষ্ম চির সম্পন্ন পাতকে অপবর্তন গ্রেটিং বলে। 

  

নির্মাণ প্রণালি : 

একটি সূচালো অগ্রভাগ বিশিষ্ট হীরার টুকরা দিয়ে একটি স্বচ্ছ সমতল কাচ পাতে দাগ কেটে বা রেখা টেনে গ্রেটিং তৈরি করা হয়। এই দাগগুলো সমব্যবধানে অবস্থিত থাকে এবং এগুলো পরস্পর সমান্তরাল হয়। এই পাতের ওপর আলো আপতিত হলে আলো দুটি দাগের মধ্যবর্তী স্বচ্ছ অংশের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। সুতরাং দুটি দাগের মধ্যবর্তী স্বচ্ছ অংশগুলো চিরের মতো কাজ করে এবং প্রতিটি দাগ অস্বচ্ছ ব্যবধানের কাজ করে। আমরা পরীক্ষাগারে যে সকল গ্রেটিং ব্যবহার করি তার প্রতি সেন্টিমিটারে প্রায় 10,000 পর্যন্ত দাগ কাটা থাকে। ফলে এক একটি চিরের প্রস্থ হয় প্রায় 10-4cm

গ্রেটিং ধ্রুবক (Grating constant) বা যেটিং উপাদান (Grating element )

সংজ্ঞা : গ্রেটিং এর একটি চিরের শুরু থেকে পরবর্তী চিরের শুরু পর্যন্ত দূরত্বকে গ্রেটিং ধ্রুবক বলে। একটি চির তথা স্বচ্ছ অংশ এবং একটি রেখা তথা অস্বচ্ছ অংশের দূরত্বকে গ্রেটিং ধ্রুবক বলে।

ধরা যাক, 

প্রতিটি চিরের প্রস্থ = a 

প্রতিটি রেখার প্রস্থ = b

:: গ্রেটিং ধ্রুবক, d = a + b

সুতরাং গ্রেটিং এর d দৈর্ঘ্যে রেখার সংখ্যা দুটি। অতএব, একক দৈর্ঘ্যে রেখার সংখ্যা 1d টি। এখন গ্রেটিং এর প্রতি একক দৈর্ঘ্যে রেখার সংখ্যা N হলে,

N = 1d 

N=1a+b

গ্রেটিং এর (a + b) ব্যবধানে অবস্থিত দুটি বিন্দুকে অনুরূপ বিন্দু (Corresponding points) বলে।

Content added || updated By
Promotion